বড়লেখার শাহবাজপুর চা বাগানের ভূমি দখল বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধার সংবাদ সম্মেলন
নিজস্ব প্রতিবেদক :: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় অবস্থিত স্কয়ার গ্রুপের মালিকানাধীন অর্গানিক চা উৎপাদনকারী শাহবাজপুর চা বাগানের প্রায় ১০০ একর ভূমি দখলের বিষয় নিয়ে ৩ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়া। বুধবার (১১ জানুয়ারি) দুপুর ১টায় বোবারথল এলাকায় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়া ও তার পরিবার। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়া। তিনি ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী সালমা বেগম, ছেলে জাহাঙ্গীর আলম, ছেলের বউ জবেদা বেগম।
লিখিত বক্তব্যে কান্নাজড়িত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন আমি ৪নং সেক্টরে সক্রিয় অংশ নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করি। আমার মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে স্থানীয় বোবারথল গ্রামের কিছু দুষ্কৃতিকারী ভূমিদস্যু শাহবাজপুর চা বাগানের বোবারথল গ্রাম সংলগ্ন কড়ইছড়া এলাকায় অবৈধভাবে ভূমি দখলে আমাকে অংশগ্রহণে বাধ্য করে। গত বছরের ০২ জুলাই বাগানের দখলকৃত স্থানে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মানববন্ধনে নেতৃত্ব দিতে আমাকে বাধ্য করা হয়। প্রকৃত অর্থে দখলকৃত এই ভূমি শাহবাজপুর চা বাগানের। এসব ঘটনার কারণে সমাজে আমার মানসম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। পরবর্তীতে দখলদাররা আমাকে ব্যবহার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে মুজিবনগর শ্রমিক কলোনী থেকে শ্রমিকদেরকে বের করে দিয়ে কলোনীর ঘরগুলো দখল করা হয়। এ কারণে বাগান কর্তৃপক্ষ আমাকে মূল আসামী দিয়ে দখলদারদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে মামলা দায়ের করে। এই অন্যায় কাজের কারণে একজন মুক্তিযোদ্বা হওয়া সত্ত্বেও আমাকে আসামী হিসেবে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রায় সাড়ে ৩ মাস কারাবাস ভোগ করি, যা অত্যন্ত অপমানজনক ও গর্হিত কাজ বলে আমি মনে করি।
উল্লেখ্য যে, এর আগে একই কায়দায় ভূমি দখলদাররা বিভিন্ন সময়ে ছোটলেখা চা বাগান, আয়েশাবাগ চা বাগান এবং ২০১৬ সালে শাহবাজপুর চা বাগানের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে মোটা অংকের চাঁদা দাবি ও আদায় করে নেয়। আমি জেল থেকে বের হওয়ার পর আমার কৃতকর্মের কারণে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হই। এ ঘটনার কারণে আমি ওই দখলদারদের সঙ্গ ও বোবারথল এলাকা পরিত্যাগ করে নিরাপড় দূরত্বে বসবাস করছি। এমতাবস্থায় ওই দখলদাররা আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। আমি নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছি।
প্রসঙ্গত, চা বাগানের ভূমি জবরদখলকারীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রায় ৮ মাস অতিবাহিত হতে চললেও উচ্ছেদ হয়নি এখনও। উপজেলা ও থানা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে চা বাগান অভ্যন্তরের একটি এলাকার কিছু অংশে দখলকারীদের স্থাপিত অস্থায়ী ঘর তুলে নিলেও বিশাল অংশ দখলে রেখে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা ও মহড়া দিচ্ছে। এমনকি বাগানের অভ্যন্তর দিয়ে বিশাল রাস্তা তৈরি করে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছে। বাগানের ব্যাপক গাছপালা, ফসলাদি কেটে সাবাড় করছে। প্রভাবশালী একটি মহলের ইন্দনে স্থানীয় দখলকারীরা অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দখলদারিত্ব পাকাপোক্ত করেছে।
সূত্র জানায়, বাগানের ভ‚মি পুনরায় চলতি বছরের ১৮ জুন ভূমিদস্যুরা মুক্তিযোদ্ধার ব্যানারে জবর দখল করে নেয়। বাগান কর্তৃপক্ষ অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক, বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানা অফিসার ইনচার্জ বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন। এরপর দখল উচ্ছেদের লক্ষ্যে গত ২৪ জুন উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার মুদাচ্ছির আলীর (সাবেক দায়িত্বে) সভাপতিত্বে এক সালিশি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর একাধিকবার সমাধানের চেষ্টা করেও কোনো সুরাহা হয়নি। বাধ্য হয়ে বাগান কর্তৃপক্ষ দখলকারীদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ ও আদালতে মামলা করে। আদালতে দায়েরকৃত মামলার প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়াসহ ১২ জনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এর মধ্যে ৫জন জামিনে বের হয়ে আবারও দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সূত্র আরও জানায়, গত ১৮ জুন দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপি’র বোবারথল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়াকে অগ্রভাবে রেখে ২৫/৩০ জনের ভূমিখেকো চক্র চা বাগানের পাল্লাথল ডিভিশনের প্রায় ১০০ একর জমি দখল করে নেয়। বাগানপক্ষ দখলে বাঁধা দিলে দখলবাজরা অস্ত্র উঁচিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। অবৈধ দখলদাররা চা বাগানের ৭০১, ৭০৩, ৭০৫, ৬০২ ও ৬০৪ দাগের প্রায় সাড়ে ৫৪৯.৯৫ একর টিলাভ‚মি দখল করে। চা বাগানের শত শত ছায়াবৃক্ষ ও প্রায় ১০ হাজার চা গাছ কর্তন করে। বাগানের জমি দখলে নিয়ে অবৈধ দখলদাররা সেখানে মুক্তিযোদ্ধার ব্যানার, রাসেল স্কোয়ার এর নাম দিয়ে দখল পাকাপোক্ত করে। দখলে নিয়ে তারা সেখানে শতাধিক অস্থায়ী ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করে।
সূত্র আরও জানায়, শাহবাজপুর মৌজার জেএল নং-৬২ এর আওতাধীন ৫টি দাগে বাগানের নির্মিত ৭টি ঘর, শ্রমিক কলোনীর ২৪টি পাকা ঘর রয়েছে। সবগুলো দখলে নিয়ে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে দখলকারীরা।
দখলবাজদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে গত ২৪ জুন সন্ধ্যায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ইউএনও কার্যালয়ে এক সমঝতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দখলদারদের ৭২ ঘণ্টার সময় দিয়ে ভূমি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হলে দখলদারদের একটি অংশ দখল ছেড়ে গেলেও অপর একটি অংশের দখলবাজরা দখল ছেড়ে যায়নি। এদিকে উপজেলা আইন-শৃঙ্ক্ষলা কমিটির সভায়ও দখল উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি।
একাধিকবার ঘটনাস্থলে থানা পুলিশ পরিদর্শন করে উভয়পক্ষের বক্তব্য নেয়। দখলদাররা সেখানে শক্তির মহড়া প্রদর্শন করে। গত ১৬ জুলাই বিকেলে থানা পুলিশের একটি দল সেখানে পরিদর্শন করতে গেলে দখলদাররা পুলিশের সাথে উত্যপ্ত বাক্য বিনিময় করে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরও একবার রপ্তানিমুখী এ বাগানটির অংশবিশেষ দখল করে অস্থায়ী ঘর তৈরি করেছিলো দখলবাজরা। এ অবৈধ দখল নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের হস্তক্ষেপ্তে বাগানটি তখন দখলমুক্ত হয়েছিলো।