বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বাঁচাতে বিদ্যালয় মাঠে রোপা আমনের বীজতলা
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় মানুষের বাড়ি-ঘর, জমি। ঘরে পানি ঢুকে ভেসে যায় ধান-চাল। প্রাণ রক্ষার্থে মানুষজন খালি হাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। এর মধ্যে পানিও নামছিলো ধীরগতিতে। ফলে আমনচাষীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এবার বুঝি বাঁচার উপায় নেই। কারণ, বন্যায় আমনের বীজতলা তলিয়ে গিয়েছিলো। ঘরে থাকা অনেকের অতিরিক্ত বীজ ধানও ভেসে গিয়েছিলো বন্যার পানিতে।
মাঠে আমন ধান বুনবেন কী করে! হাকালুকি হাওরপারের কৃষকের তাই মাথায় হাত। কৃষকের এমন দুর্দিনে এগিয়ে আসে স্থানীয় কৃষি বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে উঁচু মাঠগুলো বীজতলা তৈরির জন্য দেওয়া হয়।
মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার ১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও একটি সরকারি সংস্থা তাদের নিজস্ব খালি মাঠ ছেড়ে দেয় কৃষকদের জন্য। সেখানে তৈরি হয়েছে বীজতলা। এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনামূল্যে দেওয়া হয় এই হালিচারা। সেই হালিচারা কৃষকেরা বুনছেন নিজেদের জমিতে।
কৃষি বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, হাকালুকি হাওরাঞ্চল এবার দীর্ঘমেয়াদী বন্যার কবলে পড়ে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে হাকালুকি হাওরপারের সুজানগর, তালিমপুর, বর্ণি ও দাসেরবাজার ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়।
বন্যার পানিতে শুধু খেতের জমিই তলিয়ে যায়নি, রাস্তাঘাট-বাড়িঘরও তলিয়ে যায়। এসব এলাকার অনেক স্থানে জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পানি আটকে ছিলো। এতোদিন আমনের বীজতলার জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় আমনচাষীরা চারা তৈরি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েন। চারা তৈরির সময়ও পেরিয়ে যেতে থাকে। চাষীদের পক্ষে হালিচারা তৈরি কিংবা কিনে নিয়ে রোপা আমনের চাষ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে বীজতলাগুলো তৈরি করা হয়েছে। চারার বয়স ২৫ থেকে ৩০ দিন হলেই জমিতে রোপণ করা যাবে। সে হিসেবে আগামী ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বীজতলার চারা আমন ধানের জমিতে বপন করার কথা।
১২টি প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণে প্রায় ১৮ বিঘা জমিতে বীজতলা করা হয়েছে। বিআর-২২ জাতের ১ হাজার ২০০ কেজি বীজ বপন করা হয়েছে। এক বিঘা বীজতলার হালিচারায় কম করেও ২০ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা যায়। আর এক বিঘা জমি থেকে ১৫ মণ ধান পাওয়া যায়। বিআর-২২ নাবি জাতের আলোকসংবেদনশীল ধান। এটি রোপণের সময় ২৫ আগস্ট থেকে ৫ সেপ্টেম্বর। এরপরও অনেকে রোপণ করেন অবশ্য। এই ধান দেরিতে রোপণ করা হলেও অগ্রহায়ণ মাসের শেষদিকে ধান পেকে যায়।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বন্যায় বড়লেখায় ৩২৫ হেক্টর বোনা আমন ধান নষ্ট হয়েছে। বন্যার ক্ষতি পোষাতে কৃষকদের জন্য বিকল্প এই উদ্যোগ নেয়া হয়। উপজেলায় এবার আমনের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ৭৬০ হেক্টর। আমনচাষী হচ্ছেন ১৩ হাজার ১৪০ জন। এই কার্যক্রমে উপজেলার মোট আমনচাষীর ৭ শতাংশ এবং বন্যাকবলিত এলাকার ১২ শতাংশ উপকৃত হবেন। ৯১০ জন কৃষক ৩৪টি বীজতলার হালিচারা রোপণ করতে পারবেন।
বীজতলা তৈরিতে চাষ, মজুরি, বেড়াসহ প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা করেছে উপজেলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে রোপা আমনের বিকল্প বীজতলার স্থানগুলো হচ্ছে বড়লেখা পৌর এলাকার রেলওয়ে যুবসংঘের মাঠ, নারী শিক্ষা একাডেমী স্কুল ও কলেজ অংশের দু’টি প্রাঙ্গণ, ইটাউরি হাজী ইউনুছ মিয়া মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়, ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়, শাহবাজপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, পশ্চিম বর্ণি আয়মনা বেগম উচ্চ বিদ্যালয়, কটালপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসা, চানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুলুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রংপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবল সরকার জানান, বন্যার পানি অনেক দিন আটকে ছিলো। কৃষকেরা আমনের হালিচারা করতে পারছিলেন না। হাওরবেষ্টিত এলাকায় হালিচারার চাহিদা আছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চাষীদের মধ্যে বিনামূল্যে এই হালিচারা বিতরণ করা হচ্ছে। কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় সরকারিভাবে বিনামূল্যে বীজ ও সার প্রণোদনা দিয়ে আরও ২২টি উঁচু ও পতিত স্থানে ৩০ বিঘা জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। এগুলো করেছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
‘বিকল্প ব্যবস্থায় বন্যাকবলিত হাওরপারের বর্ণি ইউনিয়নের কাজিরবন্দ, ছালিয়া, নয়াগ্রাম, সৎপুর, পাকশাইল; তালিমপুর ইউনিয়নের পশ্চিম গগড়া, দ্বিতীয়ারদেহী, মুর্শিবাদকুরা, কুটাউড়া, হাল্লা; সুজানগরের জগড়ি, তেরাকুঁড়ি, দশঘরী, উত্তর শাহবাজপুরের অর্জুনপুর, আতুয়া, ভট্টশ্রী এবং দাসেরবাজারের সোনাপুর, চানপুর, ধর্মদেহী ও মাইজমজুরি এলাকার চাষীদের কথা চিন্তা করে এই বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।’
আলাপকালে দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস বলেন, স্কুলের মাঠ এখন খালিই পড়ে আছে। বন্যাদুর্গত মানুষকে সহযোগিতার কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েই মাঠে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে। চারা উত্তোলনের পর প্রশাসনের সহযোগিতায় মাঠ ঠিক করে নেওয়া হবে।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী জানান, বন্যার পর দেখা গেলো পানি ধীরে নামছে। হালিচারা করার জন্য জায়গা নেই। তাই উপজেলা কৃষি পুনর্বাসন কমিটি থেকে খালি জায়গা, স্কুলমাঠ ও উঁচু স্থানের পতিত জমিতে হালিচারা করা হয়েছে। যাদের হালিচারা করার সুযোগ ছিলো না, এখন তাদের সহযোগিতা করা হবে।