হাকালুকি হাওরে ৫০ বছরের ইতিহাসে যে দৃশ্যে বিষ্ময়, জনমনে কৌতূহল
আব্দুর রব, নিজস্ব প্রতিবেদক :: এশিয়ার বৃহত্তম ও দেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমি হাকালুকি হাওরে শনিবার (২৩ জুলাই) বিকেলে হঠাৎ করে সৃষ্ট জল টর্নেডোর ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। হাওরে বেড়াতে যাওয়া দর্শনার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মুঠোফোনে ধারণকৃত ওই ভিডিও নিয়ে আলোচনা এখন উপজেলা, জেলা ছাড়িয়ে সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে। সাগরে এমন দৃশ্য দেখা গেলেও হাওর এলাকায় তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। নিকট অতীতে অর্থাৎ গত ৫০ বছরেও এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছে কি-না তা নিয়ে যেমন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ তেমনি ওই দৃশ্যের বিজ্ঞানসম্মত কারণও খোঁজছেন অনেকে। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিতে মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীদেরকেও অনেকে ফোন দিয়ে তা জানতে চাচ্ছেন। তবে দীর্ঘদিন থেকে ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতার দুর্ভোগে থাকা হাকালুকি হাওরতীরের বাসিন্দারা বলেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে এটা আল্লাহর কুদরত ও রহমত। এই টর্নেডোর পর ওই এলাকায় অনেক পানি কমেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় বাসিন্দাসহ একাধিক সূত্র জানায়, শনিবার গোধূলীলগ্নে হঠাৎ করে হাকালুকি হাওরের চাতলাবিল ও বাইলাকান্দির মধ্যবর্তী জলরাশির ওপর জল টর্নেডো শুরু হয়। এমন দৃশ্য সরাসরি অবলোকন করেন ও নিজেদের মুঠোফোনে তা ধারণ করেন বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া উপজেলার হাওরপারের মানুষসহ হাওরে নৌকা ভ্রমণে যাওয়া লোকজন। তারা বলেন, হঠাৎ হাওরের জলকুÐলীর মতো ঘূর্ণন গতিতে আকাশের দিকে উঠে কালো মেঘের ভেতর গিয়ে প্রবেশ করে। এ অবস্থার স্থায়ীত্বকাল ছিলো প্রায় ১৫ মিনিট। ওই সময় হাওরের কয়েক কিলোমিটার এলাকা থেকে ওই স্থানে ছুটে যাওয়া পানির ¯্রােত ছিলো অত্যন্ত প্রবল। হাওরপারের মানুষ প্রথমবারের মতো সরাসরি জলটর্নেডো প্রত্যক্ষ করেন ও অনেকেই মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করেন। এরপরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয় এটি। প্রথমদিকে অনেকে ওই ভিডিও নিয়ে নানা সন্দেহ পোষণ করলেও পরে তা প্রমাণিত হয় ওই ভিডিওটি হাকালুকির-ই।
হাওরতীরের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার সন্ধ্যার কিছু আগে হঠাৎ দেখেন হাওরের ভেতর পানি ও আকাশের মধ্যে হাতির শুঁড়ের মতো কিছু একটা ঘূর্ণন হচ্ছে। অনেকেই এমন দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যান। বিশেষ করে হাওরে নৌকা ভ্রমণে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আতংক বিরাজ করে। ঘূর্ণন দুর্বল হয়ে আসার পরই শুরু হয় ঝড় ও বৃষ্টি। আর তখনই অনেকেই তা ভিডিও ধারণে করেন। ফেসবুকে লাইভকারী অনেকেই লিখেন, বাতাসের টর্নেডো দেখেছি জলের টর্নেডো দেখলাম এই প্রথম। বেশ কয়েক বছর আগে হাকালুকি হাওরে এ ধরণের দৃশ্য দেখা গিয়েছিলো বলে অনেকেই জানিয়েছেন। তবে এ প্রজন্মের সবাই এই প্রথম এমন দৃশ্য দেখে তা ভিডিও ধারণ করেন। ওই টর্নেডোর কারণে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। অনেকেই টর্নেডোর বিজ্ঞানসম্মত বক্তব্য তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তারা সংজ্ঞা দিচ্ছেন, টর্নেডো এক ধরণের ঝড়, যা বায়ুস্তম্ভের আকারে সৃষ্ট প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণায়মান ঝড় যা মেঘ (সাধারণত কিউমুলোনিম্বাস, ক্ষেত্রবিশেষে কিউমুলাস) এবং পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে সংযুক্ত থাকে। টর্নেডোর আকৃতি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি দৃশ্যমান ঘনীভূত ফানেল আকৃতির হয়। যার চিকন অংশটি ভূপৃষ্ঠকে স্পর্শ করে এবং এটি প্রায়শই বর্জ্যের মেঘ দ্বারা ঘিরে থাকে।
আবহাওয়া বিজ্ঞানের শব্দকোষ অনুযায়ী, টর্নেডো হল প্রচণ্ড বেগ ঘূর্ণনরত একটি বায়ুস্তম্ভ, যা ভূপৃষ্ঠের সংস্পর্শে একটি কিউমুলির্ফম মেঘ থেকে ঝুলন্ত বা এর নীচে থাকে, এবং প্রায়শই (কিন্তু সব সময় নয়) একটি ফানেলাকৃতির মেঘ হিসেবে দৃশ্যমান থাকে। টর্নেডো তৈরি হয় অনেকটা কালবৈশাখীর নিয়ম মেনে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, সমুদ্র থেকে গরম জলীয়বাষ্প ভরা বাতাস সমতলে ঢুকে ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে থাকে। একসময়ে তা ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে চলে যায়। আর তার থেকেই তৈরি হয় উল্লম্ব মেঘ। উল্লম্ব মেঘ উচ্চতায় বাড়তে থাকে এবং একসময় সেই মেঘ ভেঙে গিয়ে তৈরি হয় কালবৈশাখী ঝড়ে। টর্নেডো তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটাও প্রায় একই রকম। তবে এ ক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহের জটিলতায় দীর্ঘকায় উল্লম্ব মেঘের ভিতরে ঘূর্ণি তৈরি হয়। সেই ঘূর্ণি একটি সরু ফানেলের আকারে (মনে হয় যেনো হাতির শুঁড়) নেমে আসে মাটির কাছাকাছি। আর মাটি ছুঁয়েই সেই দৈত্যাকৃতি ঘূর্ণায়মান ফানেল তার কেন্দ্রের দিকে সব কিছু টেনে নেয়। ১৯৮৯ সালের ২৬ এপ্রিল মানিকগঞ্জ জেলায় শক্তিশালী টর্নেডোতে মারা গিয়েছিলেন ১৩০০ মানুষ।
সুজানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ঘটনাটি সত্য। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে এমন দৃশ্য এলাকার শত শত মানুষ দেখেছেন। এ ঘটনায় এলাকায় বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী জাপানের কাইটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রফেসর ড. শি থাইচি হায়াসিসের বরাত দিয়ে বলেন, এটি এক ধরণের টর্নেডো। মূলত টর্নেডোর কারণে এ রকমটি হয়ে থাকে। তবে এ ধরণের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। তিনি আরও জানান, জলের উপর শক্তিশালী টর্নেডো সৃষ্টি হলে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণয়মান বাতাসের টানে জল স্তম্ভাকারে আকারে উপরের দিকে উঠতে থাকে। জল দিয়ে মোড়ানো বাতাসের তৈরি টর্নেডোর ফলে এমনটা হয়। এটাকে জলস্তম্ভ বলা হয়। বাংলাদেশে এটি ‘মেঘশূর’ নামেও পরিচিত। তিনি বলেন, ‘এই টর্নেডোর ভেতরে ঘূর্ণনের শক্তি ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার হতে পারে। কেউ যদি এর মধ্যে পড়ে যায়, তবে উড়িয়ে নিতে পারে।’
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী জানান, বনবিভাগের হাল্লা ফরেস্ট ক্যাম্পের ইনচার্জ মোতাহার হোসেন ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি তাকে স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ দিয়েছেন। আসলে এটি জল টর্নেডো। ছোট আকারের ও জনহীন এলাকায় হওয়ায় কোনো ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। হাকালুকি হাওরে ইতোপূর্বে এ ধরণের জল টর্নেডো হয়েছে বলে কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি।