পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রেই পাঠদান করাচ্ছেন দুই শিক্ষক
নিজস্ব প্রতিবেদক :: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পানিবন্দী লোকজনের অস্থায়ী বসবাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৫২টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৫৪টি দুর্গত পরিবার। আশ্রিত পরিবারের সাথে রয়েছে তাদের স্কুল-মাদ্রাসা পড়ুয়া ছেলেমেয়েও। উপজেলার চারিদিকে বন্যার পানি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। খেলাধুলারও পরিবেশ নেই। ফলে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে চার দেয়ালের মাঝে অনেকটা বন্দী সময় কাটাচ্ছে শিশুরা। এতে শিশুদের মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা এসব শিশুদের কথা ভেবে অনুকরণীয় এক উদ্যোগ নিয়েছেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালেয়র প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস। তিনি আশ্রয় কেন্দ্রে কোমলমতি শিশুদের পাঠদানের পাশাপাশি গান-গল্পে তাদের মাতিয়ে রাখছেন। শুধু তাই নয়, বিনামূল্যে তাদের বই, খাতা, কলমও কিনে দিয়েছেন। শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাসের এমন মহতি উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা শিশুদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকরাও বেশ খুশি।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট ভয়াবহ দীর্ঘ বন্যায় বড়লেখা উপজেলার ৩ শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে বাড়ি-ঘর ছেড়ে মানুষজন পরিবার নিয়ে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। এগুলোর মধ্যে দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫৪ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারে কোমলমতি শিশুরাও আছে আশ্রিত হিসেবে। বর্তমানে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ বন্যায় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিবন্দী হওয়ায় বন্ধ রয়েছে। এতে তারা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। ফলে তাদের লেখাপড়ার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। চারদিকে বন্যার পানি থাকায় কোথাও খেলাধুলারও পরিবেশ নেই। তাই আশ্রয় কেন্দ্রে শিশুরা বন্দী সময় কাটাচ্ছিলো। এই অবস্থায় শিশুদের মনে যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে সেজন্য এসব শিশুদের জন্য কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস। তিনি তাদের পাঠদানের উদ্যোগ নেন। গত ২২ জুন থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেন। প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত দুই শিফটে চলে পাঠদান।
সরেজমিন দেখা গেছে, দাসেরবাজার উচ্চ বিদ্যালেয়র একটি শ্রেণীকক্ষে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। তাদের মধ্যে ১৭ জন উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে দু’জন ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আর অবশিষ্ট ৭জন দাসেরবাজার ও ঈদগাহ বাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ সময় তাদের ইংরেজি বিষয়ে পড়াচ্ছিলেন শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস। এর আগে তাদের গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করেন একই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক (কৃষি) হাসিম আলী।
শিক্ষার্থীরা জানায়, তাদের বাড়ি-ঘর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় পরিবারের সাথে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। বিদ্যালয়ে পানি থাকায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস তাদের বই, খাতা ও কলম কিনে দিয়েছেন। এখানে তাদের ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। এতে তারা বেজায় খুশি।
অভিভাবক শামীম আহমদ ও আবুল হোসেন বলেন, স্কুল বন্ধ থাকায় তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। এসব নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস ও হাসেম আলী তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে পড়াচ্ছেন। বই-খাতা কিনে দিয়েছেন। এতে তাদের দুশ্চিন্তা কমেছে। এজন্য তারা শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
প্রধান শিক্ষক দীপক রঞ্জন দাস বলেন, আমার বিদ্যালয়ে ৫৪ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এসব পরিবারে ছোট শিশু আছে। বন্যায় বাড়ি-ঘর ছেড়ে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে। বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এর মধ্যে খেলাধুলারও পরিবেশ নেই। শিশুরা সারাদিন আশ্রয় কেন্দ্রে বন্দী সময় কাটাচ্ছিলো। এভাবে দীর্ঘদিন থাকলে এসব শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে পারে। অনেকে আবার ঝরেও পড়তে পারে। আমিও সারাদিন বিদ্যালয়ে থাকি। তাই শিশুদের পাঠদানের উদ্যোগ নিই। বই-খাতা কিনে দিয়েছি। আমি আর আমার বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হাসেম আলী মিলে তাদের ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াচ্ছি। এতে শিশুরাও আনন্দিত। তাদের পরিবারও খুশি।