‘খুব কষ্টে দিন যার’ : ঈদহীন দিন বন্যার্তদের
নিজস্ব প্রতিবেদক :: হাকালুকি হাওরপারের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা নেহারুন বেগম। বন্যায় তার ঘর-দুয়ার সব ভেঙে গেছে। এই অবস্থায় পরিবার নিয়ে হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রায় এক মাস হতে চলেছে। বার বার বৃষ্টিতে পানি কেবল বাড়ছেই। বন্যার পানি না নামায় নেহারুনের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। তাই তাকে এবার আশ্রয় কেন্দ্রে ঈদ করতে হয়েছে।
হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে কথা হয় নেহারুন বেগমের সঙ্গে। ঈদ কীভাবে কাটছে জানতে চাইলে নেহারুন বেগম বলেন, ‘আমরার ঈদের আনন্দ বন্যায় কাড়িয়া নিছেগি। বন্যায় আমরারে একেবারে শেষ করি দিছে। ঘর-দুয়ার সবতা ভাঙি গেছে। পরিবার নিয়া আশ্রয় কেন্দ্রে আইজ প্রায় ১ মাস ধরি আছি। খুব কষ্টে দিন যার। আশ্রয় কেন্দ্রে আইছলাম শান্তির লাগি। ইকানো আইয়া মনে অর আমরা অপরাধ করছি। একদিন ইউএনও সাহেব হুখনা (শুকনো) খাবার ও একদিন মন্ত্রী চাউল-ডাইল অতা তোড়া দিছইন। আর দুই তিন-দিন খিচুড়ি আর পোলাও পাইছি। ইতায় তো পেট ভরে না। ছেলের রুজি নাই। মাইনসর কাছে হাত পাতিয়ার। বাইরা থাকি কেউ ত্রাণ লইয়া আইলে মেম্বার-চেয়ারম্যানে আশ্রয় কেন্দ্রে দিতে দেইন না। আমরা কি কষ্টে আছি এটা আল্লাহ দেখরা। একবার খাইতে পারলে আরেকবার খাইতে পারিয়ার না। এই কষ্টটা কইয়া বুঝানি যাইতো নায়। ঈদের একটা সময় কেউ আমরার খোঁজ নিছে না। নাতি-নাতিন লইয়া কষ্ট করি চলা লাগের। কষ্টের মাঝে বাড়ির বাইরা কিওর (কিসের) ঈদ। ঘরে ঠিকমতো চাউল-খরচপাতি কিছুই নাই।’
নেহারুন বেগমের মতো মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকার মানুষদের যেনো ঈদের আনন্দ স্পর্শ করতে পারেনি। বিশেষ করে বড়লেখা উপজেলার ৪১টি আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা মানুষের মনে ঈদ উৎসবের কোনো আমেজ নেই। কারণ তাদের সব আনন্দ ভেসে গেছে বানের জলে।
একই আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে উঠেছেন তাজুল ইসলাম। তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বন্যায় হাট-বাজার তলিয়ে যাওয়ায় তিনি এখন বেকার। ঈদের দিন কীভাবে কাটাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২৫ দিন ধরে আছি আশ্রয় কেন্দ্রে। কাম-কাজ নাই। আশ্রয় কেন্দ্রে আইয়া সরকারি হুখনা (শুকনো) খাবার ও একদিন মন্ত্রী চাউল-ডাউল অতা দুইদিন পাইছি। আর কেউ আমরার খোঁজ নেয়নি। সরকারিভাবে আমরার কেউ খোঁজও নিছে না। প্রমাণ দিতে পারলে আমরারে যে শাস্তি দিবা আমরা মানিয়া নিমু। আমরা অসহায় হওয়ায়ই আশ্রয় কেন্দ্রে আইছি। কোনো খরচ নাই ঘরে। হাতে টাকাও নাই। পুরান কাপড়, নিজের ঘর ছাড়া স্কুলে আছি। ঈদ কিলা কাটছে ইতা আপনারাউ বুঝইন।’
কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র ঘুরে কথা হয় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা লোকজনের সঙ্গে। তারা জানিয়েছেন, এবারের ঈদুল আযহায় তাদের কোনো আয়োজন নেই। অন্য বছরগুলোতে সাধ্যমতো কেনাকাটা করেন তারা। ঈদে সবাই মিলে আনন্দ করতেন। কিন্তু এবার তাদের মনে কোনো আনন্দ নেই।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী জানান, ৫০টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৪০টির মতো আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষ আছেন। অন্যগুলোয় যারা ছিলেন, তাদের অনেকের বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। তাই তারা বাড়িতে চলে গেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে একটা গরু দেওয়া হয়েছে। ঈদের দিন রান্না করে আশ্রয় কেন্দ্রের বন্যার্ত মানুষকে খাওয়ানো হয়েছে। বন্যার পানিতে যারা আটকে থেকে কোরবানি করতে পারতেছে না; যতটুকু পারা যায় তাদেরও দেওয়া হবে। এছাড়া ৪০০ প্যাকেট খাদ্যদ্রব্য ঈদ উপহার হিসেবে আশ্রয় কেন্দ্রে বিতরণ করা হয়েছে। গত শনিবার কিছু বিতরণ করা হয়েছে। ঈদের দিন বাকিগুলো বিতরণ করা হয়।