পরিবার নিয়া নিরাপদ হইছি, কিন্তু পেট চলবো কিলা?
নিজস্ব প্রতিবেদক :: রাজু মিয়া (৩৫)। বাজারে বাজারে মাছ বিক্রির আয়ে চলে সংসার। নিজের চাষের যে জমি আছে তা থেকে যে ধান হয় বছরের কয়েক মাস তাদের চলেই যায়। হাকালুকি হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকুরা গ্রামের বাসিন্দা রাজু মিয়াদের বন্যার সাথে লড়াই বংশপরম্পরা ধরে। তবে এবারের বন্যার লড়াইটা তাদের কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
গত শনিবার পরিবার নিয়ে রাজু আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ির অদূরের হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে। কেবল রাজুই নন, তালিমপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের বহু মানুষ এখন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে না গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ আবার অনন্যোপায় হয়ে পানির মধ্যেই ঘরবন্দী।
রাজু মিয়ার সাথে কথা হয় হাকালুকি উচ্চ বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রে। তিনি বলেন, ‘পানি বাড়ছে। এটা বুঝতেছি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমনভাবে বেড়েছিলো। নিজেদের জীবন নিয়ে কোনোমতে স্কুলে আশ্রয় নিয়েছি। ঘরে ধান-চাল সব রাখিয়া আইছি (রেখে আসছি)। নিজের একটা নৌকাও নাই যে এগুলো লগে লইয়া যাইতাম (সাথে নিযে যাবো)। ঘরের মধ্যে ধান-চাল পানিতে ভিজিয়া নষ্ট হয়েছে। এখন মানুষের হাতের দিকে চাইয়া আছি। কেউ দিলে আমরা খাইতাম। রুজি-রোজগারও নাই। বাজার-ঘাট সব বন্ধ হয়ে আছে।’
এখানেই কথা হয় মুর্শিবাদকুরা গ্রামের তাজুল ইসলামের (৫৫) সাথে। তিনি বলেন, ‘ঘরে যা আছে তা রাখিয়া আইছি। লগে আনার পরিস্থিতি আছিল না। সব শেষ। আশ্রয় কেন্দ্রে আইছি, তুড়া (অল্প) চিড়া-মুড়ি পাইছি বাবা। ভাতের পেট। তোলা পানিয়ে পেট ভরে না। এখন কপালে দুর্গতি থাকলে তো আর কষ্ট করা ছাড়া উপায় নাই রেবা।’
পাশে দাঁড়ানো জগদীশ দাস (৩০) বলেন, ‘আশ্রয় কেন্দ্রে আওয়া লাগবো। এটা জীবনে চিন্তা করছি না। বন্যায় ঘরের বেড়া ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে পানি। তাই এখানে আইছি। ঘরের কোনতা আনতাম পারছি না। ইখানো আইয়াও লড়াই করা লাগের। পাটনার একজন ২০০ টাকা দিছে। ওটা দিয়া চাউল আনিয়া খাইছি। পরিবার নিরাপদ হইছে। কিন্তু পেট চলবো কিলা?’ তিনি বলেন, ‘ রুজি নাই। কে-কতো দিন সায্য (সাহায্য) দিয়া চালাইবো। নিজের যুদ্ধ নিজেরেই করা লাগবো।’
রাজু, জগদীশ, তাজুলদের মতো একই অবস্থা বড়লেখা উপজেলার সুজানগর, বর্ণি, দাসেরবাজার, নিজবাহাদুরপুর, উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের মানুষের। গত কয়েকদিনের টানা ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছেন প্রায় দেড় লাখ মানুষ।
উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার অন্তত তিনশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ অবস্থায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় খোলা হয়েছে ৩৫টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র। প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পাকা সড়ক পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ, ইউনিয়ন ও উপজেলা সড়ক রয়েছে। বিশেষ করে হাকালুকি হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের বেশিরভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। যোগাযোগের একমাত্র ভরসা নৌকা। এছাড়া সুজানগর, বর্ণি, দাসেরবাজার, নিজবাহাদুরপুর, উত্তর শাহবাজপুর, দক্ষিণভাগ উত্তর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের রাস্তা তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী মানুষ দুর্ভোগে আছেন। এসব ইউনিয়নের যাদের ঘরে পানি উঠেছে তারাও আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রে।
এদিকে বন্যায় বড়লেখা উপজেলার ১৫১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ৫৮টি পানিবন্দী এবং ২৩টি বিদ্যালয়কে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোতে শ্রেণী কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। ১৫টি পানিবন্দী অবস্থায় আছে। এগুলোতে শ্রেণী কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
১ হাজার পরিবারে খিচুড়ি বিতরণ : মঙ্গলবার (২১ জুন) দুপুরে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ, ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী, ভাইস চেয়ারম্যান তাজ উদ্দিন ও থানা অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর হোসেন সরদারের সহযোগিতায় তালিমপুর ইউনিয়নের ১ হাজার পরিবারের মধ্যে রান্না করা খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। দুর্বারমুক্ত স্কাউট দল বিতরণে সহযোগিতা করে।
মেডিকেল টিমের ঔষধ বিতরণ : মঙ্গলবার বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে গঠিত মেডিকেল উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন ও অন্যান্য সাধারণ জরুরী ঔষধ বিতরণ করা হয়েছে।
বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক আমরা দুর্গত এলাকার খোঁজখবর রাখছি। মঙ্গলবার সকল আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবারের পাশাপাশি খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া যে সকল সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণসামগ্রি বিতরণ করা হচ্ছে, তাদের সাথে আমরা সমন্বয় রাখছি। যাতে সকল মানুষের হাতে খাবার ও ত্রাণসামগ্রি পৌঁছিয়ে দেওয়া যায়।’