জেলার মধ্যে বন্যায় বড়লেখা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত : তিনশত গ্রাম প্লাবিত, ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী
শিশুসহ ২জনের মৃত্যু, আহত ৫, দোকানপাটের ব্যাপক ক্ষতি
জালাল আহমদ :: মৌলভীবাজারের বড়লেখায় টানা ভারী বর্ষণ ও ভারতের মেঘালয়ে ভারী বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পৌর এলাকা ও সদর এলাকা তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা বর্ষণ শুরু হয়। এতে শুক্রবার কেউ-ই ঘর থেকে বের হতে পারেননি। মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েন শ্রমজীবিসগ নি¤œআয়ের লোকজন। পৌর শহরের ২ শতাধিক দোকানপাটে পানি ঢুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এসব পানিতে হাকালুকি হাওরের পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উপজেলার ০১টি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নের অন্তত ৩০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পৌর শহরের সরকারি খাদ্য গোদাম, বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ও দোকানপাটে পানি উঠেছে। এছাড়া উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষজন। পানিতে চান্দগ্রাম- মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তা ও ফসলের মাঠ। ভেসে গেছে শতাধিক ফিসারি ও পুকুরের মাছ। সরকারি খাদ্য গোদামের মালামাল নষ্ট হবার আশংকা দেখা দিয়েছে। টিলাধ্বসে ১জন নিহত ও ৫জন আহত হয়েছেন। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ২ শতাধিক টিলাধ্বসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে গত ১৮ জুন সকাল সাড়ে নয়টায় ভারী বর্ষণে উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউপি’র আয়েশাবাগ চা বাগানে টিলাধ্বসে বসতঘরের উপর পড়ে রাজন বুনার্জি (৬০) নামের ১জন চা শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ সময় ৪জন আহত হয়েছেন। এছাড়া বড়লেখা সদর ইউপি’র কেছরিগুল গ্রামে টিলাধ্বসে ১জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে পৌরসভার ০২নং ওয়ার্ডের আদিত্যের মহাল এলাকায় ঢলের পানিতে পড়ে গত ১৮ জুন তলিয়ে যাওয়া এক শিশুর মরদেহ রোববার (১৯ জুন) উদ্ধার করা হয়েছে। সে আদিত্যের মহাল এলাকার শাহাব উদ্দিনের মেয়ে সুমাইয়া বেগম (১০)। এছাড়া কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শত শত পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
এদিকে গত শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বড়লেখার বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শন করে উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দুর্যোগ মোকাবেলায় জরুরী সভা করেছেন। এ সময় তিনি জনদুর্ভোগ লাঘবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুরো জেলার মধ্যে বন্যায় বড়লেখা উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
উত্তর শাহবাজপুর ইউপি’র চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, আয়েশাবাগ চা বাগানে শনিবার সকালে টিলাধ্বসে ১জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ৪জন আহত হয়েছেন। টিলার পাদদেশে যারা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন, তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
পৌরসভার মেয়র আবুল ইমাম মো. কামরান চৌধুরী বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বড়লেখা পৌরসভার বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে পানি উঠেছে। এতে অন্তত ৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার শহর থেকে পানি নেমে গেলেও পৌরসভার নিচু এলাকা ও এখনও পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এছাড়া পৌর শহরের প্রায় সবক’টি দোকানে পানি উঠে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া আদিত্যের মহাল এলাকায় শনিবার ঢলের পানিতে পড়ে তলিয়ে যাওয়া এক শিশুর মরদেহ রোববার সকালে উদ্ধার করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী জানান, বড়লেখায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ও টিলাধ্বস প্রতিরোধে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। পাশাপাশি ২১ টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা উবায়েদ উল্লাহ খান জানান, বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য শুকনো খাবার প্রস্তুত করা হয়েছে। রোববার আমরা পানিবন্দি এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করেছি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী মঈন উদ্দিন বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ২০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রয়েছে। প্রায় ৩ হাজার ট্যাবলেট বিতরণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও নলকূপের প্লাটফর্ম উচুকরণ ও আশ্রয় কেন্দ্রে নলক‚প স্থাপন কার্যক্রম চলমান আছে।
পল্লী বিদ্যুতের ডিজিএম এমাজ উদ্দিন সরদার জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পল্লী বিদ্যুতের সাব-স্টেশন পানিতে নিমজ্জিত ছিলো। পানি এখন নেমেছে। তবে ভারী বৃষ্টি হলে তা আবার তলিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন স্থানে ২০টি বড় গাছ পড়েছে। ১৮টি স্থানে তার ছিঁড়েছে। ২২টি স্থানের কোথাও পল্লী বিদ্যুতের পোল ভেঙে গেছে, কোথাও হেলে পড়েছে এবং কোথাও আবার তা পড়ে গেছে। ২৬টি মিটার ভেঙে গেছে। ১৬টি ইন্সুলেটর ভেঙে গেছে। ০৮টি ক্রস-আর্ম ভেঙে গেছে। ১২টি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে গেছে। ২১ কিলোমিটার লাইন পানিতে তলিয়ে গেছে। কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতের লোকজন লাইন মেরামতে কাজ করছেন। পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা শামীম মোল্লা জানান, ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে চান্দগ্রাম-মৌলভীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান তলিয়ে গেছে। আমাদের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন অফিসেও পানি উঠেছিলো। রোববার ভোরে পানি নেমে গেছে। তবে ভারী বৃষ্টি হলে তা আবার তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত আছি।
এদিকে এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে পানিতে এখন থৈ থৈ অবস্থা। পানি ক্রমেই হাওর তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়ে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে শহর এলাকার নিম্নাঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসছে। ভয়াবহ স্থায়ী বন্যার আশংকা করা হচ্ছে। সর্বত্র এখন পানিতে একাকার হয়ে আছে। বড়লেখার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা হলো এবার। এর কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে, হাওরে পলিমাটি জমে ভরাট, নদী-নালা ও খালবিলের নাব্যতা হারানো, অপরিকল্পিতভাবে বাসাবাড়ি ও ভবন নির্মাণ, পানি প্রবাহের গতিপথ বন্ধ, টিলা ও পাহাড় কাটা, বনভূমি উজাড়সহ মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বড়লেখায় এবার ভয়াবহ বন্যা। অপরদিকে বড়লেখার অন্যতম নদী সুনাই, বরুদল ও কণ্টিনালা ও ষাটমা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।