বড়লেখার তিন ‘রাজাকারের’ প্রাণদণ্ড
নিজস্ব প্রতিবেদক :: একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৌলভীবাজারের বড়লেখার দুই ভাইসহ তিনজনের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। দণ্ডিত তিন যুদ্ধাপরাধী হলেন-আব্দুল মান্নান ওরফে মনাই, আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল এবং তার ভাই আব্দুল মতিন। তাদের মধ্যে আব্দুল মতিন পলাতক; বাকি দু’জন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বৃহস্পতিবার (১৯ মে) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বোর্ড এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন-বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার ও কেএম হাফিজুল আলম। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন-আব্দুল আজিজ ওরফে হাবুল, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল মতিন। এর মধ্যে আব্দুল মতিন পলাতক রয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২৪০ পৃষ্ঠার এ রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনান তিন বিচারক। যুদ্ধাপরাধের পাঁচ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিন আসামীর সবার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর মধ্যে আজিজ ও মতিনকে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অন্য দু’টি অভিযোগে তাদের মোট ৩০ বছর করে কারাদণ্ড হয়েছে। আর মান্নানকে এক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং আরেক অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।
আসামীদের মধ্যে মনাইয়ের পক্ষে আইনজীবি হিসেবে ছিলেন এম সারোয়ার হোসেন, হাবুলের পক্ষে ছিলেন আব্দুস সাত্তার পালোয়ান। হাবুলের ভাই পলাতক আব্দুল মতিনের পক্ষেও রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবি হিসেবে আব্দুস সাত্তার পালোয়ানই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি।
এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রসিকিউটর মুন্নি বলেন, “এই রায়ে আমি একজন নারী হিসেবে বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানাচ্ছি, যারা এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে ট্রাইব্যুনালে আসতে পেরেছেন এবং যারা আসতে পারেননি, সবার প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। এই রায়ে আমরা প্রসিকিউশন পক্ষ সন্তুষ্ট।”
অন্যদিকে আসামী আজিজ ও মতিনের আইনজীবি আব্দুস সাত্তার পালোয়ান এবং মান্নানের আইনজীবি সারোয়ার হোসেন বলেন, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের এ রায়ের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারবেন কারাগারে থাকা আজিজ ও মান্নান। আর মতিনকে আপিল করতে হলে আগে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
এর আগে গত ১৭ মে (মঙ্গলবার) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল রায় ঘোষণার জন্য ১৯ মে দিন ধার্য করেছিলেন। গত ১২ এপ্রিল উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি যে কোনো দিন (সিএভি) রায় ঘোষণার জন্য রেখে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর এ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর শেষ করা হয়। তদন্তে তিন আসামীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মৌলভীবাজারের বড়লেখা এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের মতো পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বড়লেখার তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ১ মার্চ মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানা পুলিশ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর ২ মার্চ আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নানকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলছে, আজিজ ও মতিন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে পালিয়ে বড়লেখায় এসে তারা হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। তখন তাদের সঙ্গে যোগ দেন মান্নান। ২০১৬ সালের ১ মার্চ গ্রেফতার হওয়ার আগে আব্দুল আজিজ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আর পলাতক মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন।
আসামী মান্নান ওরফে মনাই ১৯৭১ সালে জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত সংস্থার ভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বড়লেখা থানা শান্তি কমিটির সদস্য হন এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।