মৌলভীবাজারে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্রাহক দুর্ভোগ চরমে
নিজস্ব প্রতিবেদক :: বিদ্যুৎ বিল, মিটার, লাইন মেরামত-সবকিছুতেই নানা কায়দা-কৌশলে নয়-ছয় আর ঘুষ-বাণিজ্য। চলমান এই গ্রাহক হয়রানির গুরুতর অভিযোগের সাথে গেল কয়েক সপ্তাহ থেকে নতুন সংযোজন ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট। কর্মকর্তাদের ঘুষ-বাণিজ্য আর বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে জেলাজুড়ে এখন চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বিদ্যুৎ গ্রাহকরা।
জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে কোনো ঘাটতি না থাকলেও কারণে-অকারণে বিদ্যুৎহীনতা যেনো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি আর লোকবল সংকটের অভিযোগ বিদ্যুৎ বিভাগের থাকলেও অনেক সময় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। আকাশে বিজলী চমকালেই বিদ্যুৎহীন অন্ধকার। জেলা শহরসহ প্রতিটি উপজেলার নাগরিকরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে তাদের দুর্ভোগের বিষয়ে অভিযোগ দিলেও মিলছে না কোনো প্রতিকার।
পবিত্র রমজান মাসে সেহরি, ইফতারি ও তারাবিহ’র নামাজের গুরুত্বপূর্ণ সময়েও থাকছে না বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের এমন চরম উদাসীনতার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থাকার পর এবার মাঠে আন্দোলনে নামছেন গ্রাহকরা। হঠাৎ এমন দুর্ভোগে দিশেহারা জেলার বিদ্যুৎ গ্রাহকরা। দীর্ঘদিন কোভিড-১৯ এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ঈদকে সামনে রেখে কিছুটা উজ্জীবিত হয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের এমন আচরণে হতবাক। একই অবস্থা শিক্ষার্থীদের। গ্রাহকরা ক্ষোভের সাথে অভিযোগ করে বলেন, এমনিতেই ভৌতিক বিল আর মিটার সংযোগের মাধ্যমে তাদেরকে চরম হয়রানি করা হচ্ছে। বাড়তি উৎকোচ দিলে সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে। তা না হলে মামলা ও জেল-জুলুমের ভয় দেখানো হচ্ছে এমনকি মিথ্যা মামলায়ও জড়ানো হচ্ছে।
কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দরা জানান, প্রায় একযুগেরও বেশি সময়ের সংযোগবিহীন অচল মিটারে ভৌতিক বিল দেখিয়ে তিন মেয়াদের কার্যনির্বাহী পরিষদের উপর মামলা করা হয়েছে। একাধিক ভোক্তভোগীরা জানালেন, কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিতরণ ও বিপনণ কেন্দ্রের ৩জন কর্মকর্তা (নির্বাহী প্রকৌশলী ওসমান গণী, সহকারী প্রকৌশলী মফিজ আলী, ক্যাশিয়ার আনছার আলী ও ১জন কর্মচারীর (লাইনম্যান) যোগসাজশে নতুন মিটার দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। কিন্তু কয়েক মাস ও বছর অতিবাহিত হলেও তাদেরকে দেওয়া হচ্ছে না মিটার। অথচ প্রতিমাসে কাগজের বিল দেওয়া ছাড়াই নগদ টাকা নিচ্ছেন। বিলের কাগজ ছাড়া কেউ টাকা দিতে অস্বীকার করলে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে মিটারবিহীন বিদ্যুৎ জ্বালানোর দায়ে তাদেরকে জেল-জরিমানও গুনতে হচ্ছে। এছাড়া গেলো কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বড়লেখা উপজেলা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। উপজেলা আইন-শৃঙ্ক্ষলা সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায়ও বিদ্যুতের ঘন ঘন বিভ্রাট নিয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে বিষোদগার করে দ্রুত প্রতিকার চাওয়া হয়। একই অবস্থা জেলার জুড়ী, রাজনগর, মৌলভীবাজার সদর, কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গলসহ ৭টি উপজেলার। নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদানে বিদ্যুৎ বিভাগের (পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুৎ) চরম উদাসীনতার বিষয়টি উপজেলার আইন-শৃঙ্ক্ষলা সমন্বয় কমিটির সভায় জোরালোভাবে উপস্থাপন হচ্ছে। নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদানে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজারে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ব্যানারে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে বক্তারা বিদ্যুৎ বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের অপসারণ, ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবিতে নানা আল্টিমেটাম দেন। তারা বলেন, এই সকল সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে কঠোর আন্দোলন নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকবেন। তারা বলেন, বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা তাদের ব্যক্তিস্বার্থে গ্রাহক হয়রানির মাধ্যমে বিভিন্ন বরাদ্দের টাকা আত্মসাত করতে গ্রাহকদের সমস্যায় ফেলছে। সরকারের সফল উদ্যোগ ও নিরবিচ্ছিন্ন সেবা জনগণের দোরগোড়ায় না পৌঁঁছিয়ে দুর্ভোগে ফেলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুলাউড়া বিদ্যুৎ বিতরণ ও বিপনণ (বড়লেখা, জুড়ী ও কুলাউড়া) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: ওসমান গণী মুঠোফোনে বলেন, গ্রাহকদের সব অভিযোগ সঠিক নয়। ঝড়-বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে (মাত্র তিনজন) কম লোকবল নিয়ে পুরো উপজেলা কাভার করতে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে লাইন মেরামত করে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দিতে। তিনি বলেন, শিগগিরই কুলাউড়ার উত্তর কুলাউড়ায় আরও একটি ৩৩/১১ হাজার কেভির সাব-স্টেশন নির্মাণ হচ্ছে। এটা নির্মাণ হলে এই দুর্ভোগ থাকবে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজার এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ দায়িত্বরত) এসএম ইকবাল বলেন, পুরো জেলায় সব জায়গায় আমাদের বিভাগের না। ওখানে পল্লী বিদ্যুতও সেবা দিচ্ছে। গেলো ১০ দিন থেকে ওই সমস্যা হচ্ছে বৈরী আবহাওয়ার কারণে।
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী সাখাওয়াত হোসেন জানান, আবহাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। মৌলভীবাজার জেলায় হাওর, পাহাড়, টিলা আর গাছ-গাছালি বেশি। বিদ্যুতের লাইন ও খুঁটি ঝড়-তুফানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো মেরামত করে লাইন সচল করতে হয়।সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি ও মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সাবেক সভাপতি ডা: ছাদিক আহমদ বলেন, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় গ্রাহক দুর্ভোগ কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি দ্রুত এ সমস্যা উত্তোরণে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা না পাওয়া নিয়ে দুর্ভোগগ্রস্ত গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসাররাও আমাকে জানিয়েছেন। আমি সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে কোনো গুরুতর কারণ ছাড়া পবিত্র রমজানে বিদ্যুহীনতায় মানুষের যাতে দুর্ভোগ না পোহাতে হয়।