হারিয়ে যেতে বসেছে সিলেট-মৌলভীবাজারে বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প
জালাল আহমদ :: একটা সময় সিলেটে মাটির জিনিসপত্রের বেশ প্রচলন বা জনপ্রিয়তা ছিলো। তবে আধুনিক শিল্পের ছোঁয়ায় সিলেটসহ মৌলভীবাজারের সাত উপজেলায় মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প ধীরে ধীরে স্মৃতির খাতায় নাম লেখতে শুরু করেছে। বর্তমান বাজারে প্লাস্টিক, স্টীল, মেলামাইন, এ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদির জিনিস বাজারে ছেয়ে গেছে। প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে মাটির জিনিসপত্র কম টেকসই, সামাজিকতা, সব মিলিয়ে গ্রাহকরা মৃৎশিল্পে ব্যবহারে অনুৎসাহিত হচ্ছে। আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তো আছেই। সব মিলিয়ে আজ সংকটের মুখে এ মৃৎশিল্প।
মাটি দিয়ে গঠন-কাঠামো অনুযায়ী শৈল্পিক কারুকার্যময় ও বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন ধরণের তৈজসপত্র তৈরি করে যারা, সেই সম্প্রদায়কে আমরা কুমার বলি। আর তাদের সেই সৃষ্টিকর্মকে শিল্পের ভাষায় মৃৎশিল্প বলে। একসময় দৈনন্দিন জীবনে মাটির তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিলো। এখনও কম-বেশি শহরাঞ্চলে মাটির তৈরি কারুকার্যময় তৈজসপত্রের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে প্লাস্টিক দ্রব্যসামগ্রির ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে এই মাটির জিনিসপত্রের প্রতি উৎসাহ হারাচ্ছেন আধুনিক সমাজের মানুষেরা।
বিক্রেতারা বলেন, মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার স্বাস্থসম্মত এবং প্রাচীনকাল থেকে এর ব্যবহার চলে আসছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই শিল্প থেকে অনেকে সরে আসছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাসহ সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় এই শিল্প আর শিল্পের সাথে জড়িতরা আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে। তবে এখনও অনেকেই আছে, যারা মাটির জিনিসপত্র কিনছেন পুরনো ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে।
ক্রেতারা বলেন, বাংলার ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে অধুনিকতার ছোঁয়ায়। এই শিল্পকে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মৃৎশিল্পী রাজকুমার বলেন, পূর্ব পুরুষের দেখানো ব্যবসা আজও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বর্তমান সময়ে ব্যবসায় টিকে থাকাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সবকিছুর সাথে এই মাটির জিনিসের দামও বাড়ছে। তাই বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হচ্ছে। লাভও হচ্ছে সীমিত। সবমিলিয়ে শিল্পটি এখন বিলু্প্তির দিকে। মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বাজার সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরী। সরকারের কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা পেলে হয়তো এ পেশা চালিয়ে যেতে পারবেন বলে তারা জানান। তা না হলে এই শিল্প বিলীন হয়ে যাবে।
এদিকে মৌলভীবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, কয়েক বছর আগেও পূর্ব নন্দিউড়া গ্রামের ১৫ পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলো। বর্তমানে কেবল তিনটি পরিবার বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে জড়িত আছেন। গ্রামটির অনেকেই তাদের পরের প্রজন্মকে এ পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত করছেন। এর মূল কারণ, মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিসের চেয়ে মেলামাইন, প্লাস্টিককে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তাই মাটির তৈজসপত্রের বেচাকেনা এখন খুবই কম।
পূর্ব নন্দিউড়া গ্রামের মৃৎশিল্পের কারিগর হরেন্দ্র পাল। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে মাটির হাঁড়ি, পাতিল, কলস, বাটি ও খেলনাসামগ্রি তৈরি করেন তিনি। তবে আগের মতো মেলা বা উৎসব না হওয়ায় কাজের তেমন চাপ থাকে না।
হরেন্দ্র পাল জানান, আমাদের বাড়ির বেশিরভাগ লোকই মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলো। একসময় মাটির তৈরি এসব জিনিসের চাহিদা থাকলেও আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ এখন আর এসবের দিকে ঝুঁকছে না। তিনি আরও বলেন, এখন আমরা মৌসুমী কারিগর হয়ে গেছি। বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে মাটির তৈরি এসব পাত্র বানাচ্ছি। আমাদের পরের প্রজন্ম এ কাজ শেখেনি। হয়তো আমাদের পর এ শিল্প আর টিকে না-ও থাকতে পারে।
আরেক মৃৎশিল্পী উপেন্দ্র পাল জানান, একসময় এ শিল্প আর টিকে থাকবে না। মৃৎশিল্প তৈরির মাটি পাওয়া যায় না। বাসন পোড়ানোর জন্য জ্বালানি কাঠেরও সংকট। করোনার প্রভাবে গত দুই বছর ধরে বেচাকেনা তেমন নেই। বাড়িতে শুধু ফরমায়েসি কাজ করছি।
নিবারণ চন্দ্র পাল বলেন, সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না থাকায় বিলুপ্তির পথে মৃৎশিল্প। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে হয়তো শেষ রক্ষা হতে পারে এ শিল্পের।
রাজনগর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার বাবুল সূত্রধর বলেন, এখন পর্যন্ত মৃৎশিল্পের জন্য কোনো সহযোগিতার সুযোগ নেই। সরকারি কোনো প্রজেক্ট আসলে আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো।
অপরদিকে একসময় সিলেটজুড়ে ছিলো বড়লেখার মাটির হাঁড়ি-পাতিলের কদর। কিন্তু এখন আর তা নেই। বিলুপ্তের পথে এ শিল্প। কালের বিবর্তনে ধাতব, প্লাস্টিক, মেলামাইন ও চিনামাটির সামগ্রির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। বেঁচে থাকার তাগিদে চৌদ্দ পুরুষের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এ পেশার অনেক শিল্পী। কম চাহিদা, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি আর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ক্রমেই অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন তারা।
একদিকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, অন্যদিকে আধুনিক যুগের যন্ত্রবিপ্লবের হুমকির মুখে পতন-এ দু’য়ের ফলে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে চলেছে মৃৎশিল্পের স্থায়িত্ব ও বিকাশের পথ।
বিলুপ্তপ্রায় সেই মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েকটি পরিবারের বাস বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউনিয়নের কুমারপাড়া (খদানগর) গ্রামে। একসময় বড়লেখার মাটির তৈরি ব্যবহার্য তৈজসপত্রের বড় জোগান আসতো এই গ্রাম থেকে। আর এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্তরা স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন। অতিকষ্টে বংশপরম্পরার এ ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে আছে চার থেকে পাঁচটি পরিবার। অথচ এ গ্রামের অন্তত ৩০টি পরিবারের জীবন-জীবিকার উৎস ছিলো এ শিল্প।
কুমারপাড়া (খদানগর) গ্রামের প্রবেশ পথে কথা হয় শতীনন্দনের সঙ্গে। অতীতের বর্ণনা দিতে গিয়ে সত্তর ছুঁই ছুঁই শতীনন্দনের চোখজোড়া চঞ্চল হয়ে ওঠে। মৃৎশিল্পের সঙ্গে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তিনি কি-না শেষ বয়সে এসে মুদি দোকান দিয়েছেন। শতীনন্দন বলেন, আগে ঘরে ঘরে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করা হতো। এখন তিন-চারটি পরিবার বানায়। লাকড়ি মেলে না। হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার মাটি পাওয়া যায় না। লাকড়ি ও মাটির দাম বেশি। তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছি। দুই ছেলে আমার, দোকানে চাকরি করে।
নতুন প্রজন্মের কেউ-ই এ পেশায় আসছেন না। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৃৎশিল্পের চরম দৈন্যদশার জন্য নতুন করে কেউ-ই এ পেশায় আসতে আগ্রহী নন।
জ্ঞানেন্দ্র রুদ্র পাল (৪৬) বলেন, মৃৎশিল্পের মূল উপাদান এঁটেল মাটি। এ মাটি দিয়ে তৈরি উপকরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হাঁড়ি, কলসি, ঘড়া, ঘাগড়া, শানকি, প্রদীপ, পাঁজাল বা ধুপতি, গ্লাস, বদনা, ঝাঁজর, চাড়ি, মটকি বা মটকা, পিঠার ছাঁচ, সরা, ঢাকনা, বাটি, ফুলের টব, পুতুল, প্রতিমা, মূর্তি প্রভৃতি।
গ্রামের শ্রীনিবাস রুদ্র পাল বলেন, আগে পাইকাররা এসে বায়না করে যেতো, ১০-১৫ দিন পরপর বিয়ানীবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা এসে তাদের মাল বুঝে নিতো। এখন আমরা দুই তিন পরিবার এই কাজ করি। বড়লেখা বাজার, দাসেরবাজার ও জুড়ী উপজেলার কামিনীগঞ্জ বাজারে এগুলা বিক্রি করি।
এ বিষয়ে বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, কুমারপাড়ায় খোঁজ-খবর নিয়ে মৃৎশিল্প ধরে রাখতে পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।